হযরত মাওলানা মুফতী নজরুল ইসলাম ভাসানী
জামিআ রাব্বানিয়া আরাবিয়ার স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম মুফতী নজরুল ইসলাম ভাসানী (দামাত বারাকাতুহুম)। এ মহা মনীষীর জীবনচরিতের প্রতিটি ভাঁজেভাঁজে রয়েছে আদর্শ মানুষ হওয়ার অনুপ্রেরণা ও সফল জীবন গঠনের মন্ত্রণা।
জন্ম ও শৈশব:
বাংলাদেশের শরীয়তপুর জেলার সদর থানার অন্তর্গত পশ্চিম ভাষানচর গ্রামে ২রা মার্চ ১৯৭৭ ঈসায়ী সনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তিনি নূরানী এক পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। তাঁর বাবা ছিলেন নিষ্ঠাবান সৎ ও ধর্মভীরু মানুষ। ইবাদত—বন্দেগীর প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল ঈর্ষণীয়। উলামা—মাশায়েখকে তিনি ভীষণ মহব্বত করতেন; এলাকায় কোন বুযুর্গের আগমন ঘটলেই তিনি সন্তানদের নিয়ে ছুটে যেতেন তাঁর দুআ আনতে।
শিক্ষা:
বংশগতভাবেই হযরতের পরিবার ছিল শিক্ষিত, রুচিশীল ও সম্ভ্রান্ত। বাল্যকালে তিনি পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ইবতেদায়ী মাদরাসায় পড়াশোনা করেন। এরপর কালকিনী হাফেজিয়া মাদ্রাসায় খুব অল্প সময়ে সুনামের সাথে হিফজুল কুরআন সমাপন করেন। তারপর কিতাব বিভাগে জামালুল কুরআন (ঢালকানগর, ঢাকা) মাদরাসায় তাইসীর জামাতে ভর্তি হন। পরবর্তীতে বাইতুল উলূম ঢালকানগর মাদরাসায় কাফিয়া জামাত পর্যন্ত পড়েন। এরপর জামিয়া রাহমানিয়া’য় শরহেজামী জামাতে ভর্তি হয়ে কৃতিত্বের সাথে ২০০০ সালে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করেন।
২০০১ সালে বসুন্ধরা ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারে এক বছর ফিকহ—ফতওয়া নিয়ে মেহনত করেন। পরে উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য ভারতে শাহী মুরাদাবাদে প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মুফতি শাব্বীর আহমদ কাসেমীর তত্ত্বাবধানে ফিকহ ও ফতোয়ার উপর তাখাসসুস করেন।
পড়াশোনায় তিনি ছিলেন সর্বসেরা। সবার পরে শুরু করেও সবার আগে হিফযুল কুরআন শেষ করেছিলেন। পুরো ছাত্র যমানায় ‘নাম্বারে আউয়াল’ ছিলেন। রাহমানিয়ার প্রথম পরীক্ষায় ৬ষ্ঠ হওয়ার পর দৃঢ় সংকল্প করেন যে, পরের পরীক্ষায় প্রথম না হয়ে মাদ্রাসা থেকে বের হবেন না। এবং পরবর্তী পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে তবেই তিনি মাদরাসার বাহিরে আসেন।
উস্তাদদের খেদমত আর তাদের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। ক্লাসের ‘ফাস্টর্ বয়’ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মনে কোনও অহংকার ছিল না। সাথীদেরকে খুব যত্নের সাথে সবক বুঝিয়ে দিতেন; অত্যন্ত ফিকিরের সাথে চমৎকার পরামর্শ দিতেন। তাই সবার মাঝে তিনি ‘মুশীরে আলা’ (প্রধান পরামর্শদাতা) হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
হযরতের দাওরায়ে হাদীসের বছর রাহমানিয়ায় বড় ধরনের ইখতিলাফ হয়। ছাত্ররা দু‘দলে বিভক্ত হয়ে অভ্যন্তরীন মনোমালিন্য ও বৈরিভাব তৈরি হয়। জামাতের যিম্মাদার হিসেবে তিনি ছাত্রদেরকে বুঝিয়ে নিরপেক্ষ ও মু‘তাদিল অবস্থান স্পষ্ট করেন। ফলে বহু ছাত্র ইখতিলাফ থেকে ফিরে আসে।
তাক্বওয়া ও খোদাভীতি:
বাড়িতে পরিপূর্ণ শরয়ী পর্দা ছিল না। হযরত তাঁর শায়েখ (ঢালকানগরের হযরতওয়ালা দামাত বারাকাতুহুম)—কে গাইরে মাহরামদের বেপর্দার বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, “হয় তাদের খুশি করো, না হয় আল্লাহকে খুশি করো!” এরপর তিনি বাড়িতে গিয়ে মায়ের মাধ্যমে গাইরে মাহরামদেরকে সামনে আসতে শক্তভাবে নিষেধ করেন। তখন থেকে তারা আর কখনো তাঁর সামনে আসতে পারেনি। পরিবার ও এলাকার মুসল্লিদের মাঝে তাঁর দীনদারির যথেষ্ট প্রভাব ছিল।
জীবনের শুরু থেকেই হযরত আত্মশুদ্ধি অর্জনের প্রতি গুরুত্ব দেন। প্রথমে যাত্রাবাড়ির শায়েখজী হুজুর হযরত মাওলানা সালাহুদ্দীন সাহেব (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)—এর সাথে এবং পরবর্তীতে ঢালকানগরের হযরতওয়ালার সঙ্গে ইসলাহী সম্পর্ক কায়েম করেন।
সব সময় তিনি সুন্নত ও তাক্বওয়ার সাথে থাকতেন। বিশেষ করে সুশ্রী ছেলেদের থেকে অত্যন্ত পরহেয করতেন। একবার একজন সুশ্রী (মেধাবী ছাত্রের) বিছানা হযরতের পাশে দেয়া হলে তিনি খুবই পেরেশান হয়ে যান। কোন সমাধান না পেয়ে তাঁর শায়েখের পরামর্শে নিজের স্পেশাল জায়গাটি ছেড়ে দিয়ে দরজার পাশে চলে আসেন। তাঁর এ নূরানী জীবনধারার কারণে ছাত্রযামানা থেকেই সাথীরা তাঁকে ‘শায়েখ’, ‘পীরসাহেব’ বলে সমীহ করতো।
হযরতের সহপাঠী ও সহকর্মীরা অকপটেই একথা স্বীকার করেন যে, তিনি একজন ‘মাদারযাদ ওলী’ (জন্মগত বুযুর্গ)। এই স্বভাবজাত তাকওয়া—খোদাভীতি ও উন্নত আখলাক—চরিত্রের কারণে তাঁর প্রাণপ্রিয় শায়েখ ও মুর্শিদ আরেফবিল্লাহ, রুমীয়ে যামানা, আল্লামা শাহ আব্দুল মতীন বিন হুসাইন হযরতওয়ালা ঢালকানগরী (দামাত বারাকাতুহুম) ছাত্র যমানাতেই (দাওরায়ে হাদীসের বছরের শেষে) অত্যন্ত জোশ ও আবেগের সাথে তাঁকে সর্বপ্রথম ‘ইজাযত’ দানে ধন্য করেন।
বুযুর্গদের সোহবত:
আমাদের দেশের বেশীর ভাগ আকাবিরে দীনের সোহবত ও শিষ্যত্ব লাভ করেছেন তিনি। বিশেষভাবে শায়েখজী হুজুর সালাহুদ্দীন সাহেব, ঢাকুবী হুজুর আব্দুল মজীদ সাহেব, শাইখুল হাদীস আজীজুল হক সাহেব, ফকীহুল মিল্লাত মুফতী আব্দুর রহমান সাহেব, হযরত মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ মুহাদ্দিস সাহেব (রহমাতুল্লাহি আলাইহিম)—সহ অনেক বুযুর্গানে দীনের শিষ্যত্ব ও খাস সোহবত লাভে ধন্য হন তিনি।
ভারতের শাহী মুরাদাবাদে থাকা অবস্থায় কুরবানীর ছুটিতে পুরো আট দিন মহিউসসুন্নাহ হযরত মাওলানা আবরারুল হক সাহেব রহ. এর একেবারে খাস সোহবত ও বিশেষ ফয়েয লাভে ধন্য হন। এছাড়া, শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রহ. এর বিশিষ্ট শাগরেদ, সাহারানপুর মাদরাসার আমরণ শাইখুল হাদীস ইউনুস পালনপুরী রহ., আরেফ বিল্লাহ রুমিয়ে যামানা হযরত মাওলানা শাহ হাকীম মুহম্মাদ আখতার হযরতওয়ালা করাচী রহ.—সহ তৎকালীন হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানের বড় বড় ওলামা—মাশায়েখের বিশেষ সান্নিধ্য ও নেক নযর লাভ করেন।
হযরত বলেন, ‘আল্লাহ পাকের খাস মেহেরবানী, একেবারে ছোটবেলা থেকেই আমি বুযুর্গানে দীনের নেক নযর ও তাদের সোহবতে বড় হয়েছি। এ কারণে তাসাউফ কেমন যেন আমার রগ—রেশায় একেবারে মিশে গেছে।’
কর্মজীবন:
ভারত থেকে তাখাসসুস সম্পন্ন করে আসার পর প্রথম বছর “দারুল ফিকরি ওয়াল ইরশাদে” মুফতী আবু সাঈদ সাহেব হুজুরের মুঈন হিসেবে এক বছর ফিকহ—ফতোয়ার খেদমত করেন। এরপর দ্বিতীয় বছর দরস—তাদরীসের খেদমত শুরু করেন ‘মারকাযুল উলূম মুগদা মাদরাসা’য়। অত্যন্ত সুমামের সাথে সেখানে এক বছর খেদমত আঞ্জাম দেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে সেই মাদ্রাসার কিছু বিষয় হযরতের তাহকীক অনুযায়ী শরীয়তসম্মত না হওয়ায়, অত্যন্ত শ্রদ্ধা ও হিকমতের সাথে তিনি সেখান থেকে সরে আসেন।
সে বছরেই হযরতের কাছে বড় বড় জামিআ থেকে প্রস্তাব আসে, তখন তিনি মুরুব্বিদের সাথে পরামর্শ করে ‘ইশায়াতুল উলূম যাত্রাবাড়ি মাদরাসা’য় খেদমত শুরু করেন।
জামিআ রাব্বানিয়া প্রতিষ্ঠা:
গতানুগতিক ধারার মাদরাসাগুলোর অন্তসারশূণ্য ব্যবস্থাপনার ফলে ইলমে দীনের দৈন্যদশা, অযত্ন—অবহেলা আর সঠিক তারবিয়াত ও পরিচর্যার অভাবে সুপ্ত প্রতিভার অধিকারী হাজারো মেধাবীদের হারিেয় যাওয়া— দেখে হযরত সর্বক্ষণ দগ্ধ হতেন অব্যক্ত এক আত্মদহনে। তিনি শিক্ষাজীবন থেকেই স্বপ্ন দেখতেন, যিদ এমন কোন জামিআ থাকতো, যেখানে হবে ইলম ও আমল, তালীম ও তরবিয়াতের মিলন মেলা। যার তালিবুল ইলমরা হবে বিদগ্ধ মুহাক্কিক ও আল্লাহওয়ালা।
সময় যত যাচ্ছিল, এ যাতনা তত তীব্র থেকে তীব্রতর ও অসহনীয় হয়ে উঠছিল। হযরতের অধ্যাপনার তখন ৩য় বছর চলছিল । হযরত নিজ মুরুব্বি ও শায়েখ ঢালকানগরের হযরতওয়ালা (দামাত বারাকাতুহুম) এর কাছে এ অব্যক্ত যাতনার কথা ব্যক্ত করেন। হযরতওয়ালা সব শুনে কিছুক্ষণ ধ্যান—মৌন থেকে দরাজ কন্ঠে বলেন, যাও “তাওয়াক্কুলানআলাল্লাহ” (আল্লাহর উপর ভরসা করে শুরু করো!) সুবহানাল্লাহ! না জানি কোন আসমানী ইশারা পেয়ে এতটা দীপ্ত কন্ঠে অনুমতি প্রদান করেছিলেন তিনি। এভাবেই শুরু হয় জামিআ রাব্বানিয়ার শুভযাত্রা।
অদম্য আত্মবিশ্বাস, তাকওয়াপূর্ণ সৎ সাহস, ইখলাসে ভরপুর সুদৃঢ় পদক্ষেপ, লক্ষ্য জয়ের দুর্বারগতি সর্বোপরি, তাওয়াক্কুল ও চোখের পানি হযরতের জীবনের উজ্জ্বল কিছু শিরোনাম। হযরত প্রায়ই বলেন, “আল্লাহর ফয়সালা ছাড়া কিছুই হয় না—এই বিশ্বাস তো আছে। সুতরাং আমি নেব আসমানওয়ালার কাছ থেকে। যার কাছে এক টাকা আর এক কোটি টাকা সমান। দুনিয়ার বাজার মন্দা থাকতে পারে, তাঁর ভাণ্ডারে কোন মন্দা নেই। কীভাবে কী ব্যবস্থা হবে, আমি তা জানি না। তবে এতটুকু জানি, তাঁর মঞ্জুরি হলে সব হয়ে যাবে। তিনি যেভাবে চান, সেভাবেই হবে। সুতরাং আমার কাজ হল, তাঁর সাথে গভীর থেকে গভীরতম সম্পর্ক করা আর নিজের সাধ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করা।”
এমনকি হযরতের আসাতিযায়ে কেরাম পর্যন্ত বলেন— ‘ও (হযরত) আল্লাহর কাছ থেকে সব চেয়ে নিয়েছে’। হযরতের খাস উস্তাদ মুফতী মানসূরুল হক সাহেব (দামাত বারাকাতুহুম) বলেন, ‘আমরা ছাত্র যামানায় ধারণা করেছিলাম, ওর দ্বারা বড় কোন কাজ হবে।’ সত্যি বলতে কী, শুধু কথার ফুলঝুরিতে নয়; বাস্তবেই যার জীবন—দর্শন এমন, তাকে ঠেকাতে পারে এমন কোন শক্তি নেই প্রভুর কুদরত ছাড়া। তাই তো নিঃস্ব, নিঃসম্বল ও রিক্ত হস্তেই হযরত জামিআ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নেমে গেলেন একমাত্র মহান প্রভুর উপর গভীর ভরসা ও বিশ্বাসের শক্তি নিয়ে। ২০০৫ সালের জেএমবির বোমা হামলার কারনে, দেশ জুড়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে অনেক কষ্টে একটি ভাড়া বাড়ি পেলেন, ভাড়ার বায়নাও করলেন ঋণ করে; নির্ভয়ে, ইখলাস ও তাওয়াক্কুলের রক্ষাকবচ নিয়ে।
হযরতের সহকর্মীরা বলেন, বড় হুজুরের মাঝে আল্লাহ পাক এমন হিম্মত ও ফিকির দান করেছেন যা সত্যিই অকল্পনীয়। হযরতের তাখাসসুসের উস্তাদ মুফতী সালমান মানসূরপুরী (ভারত) দামাত বারাকাতুহুমতো এভাবে বলেছেন یہ تو ہمت کا پہاڑ ہے ‘এ ছেলেটি তো হিম্মতের পাহাড়’! হযরতের উস্তাদ মুফতী শাব্বীর আহমাদ কাসেমীর (ভারত) মত বিদগ্ধ আলেম হযরত সম্পর্কে শাহী মুরাদাবাদে উস্তাদদের মিটিংয়ে বলেছিলেন یہ طالب علم بہت محنتی ہے এ তালেবে ইলম খুবই মেহনতী।
২০০৫—২০২০। সেই কষ্ট পূর্ণ জীর্ণশীর্ণ ভাড়া বাড়ির রাব্বানিয়া মাত্র পনের বছরের ব্যবধানে আজ প্রায় চার বিঘা জায়গা জুড়ে সাড়ে ছয় হাজার স্কয়ার ফিটের দৃষ্টি নন্দন সুপ্রশস্ত অত্যাধুনিক সাত তলা ভবন ও একটি তিন তলা ভবনসহ অন্যান্য অবকাঠামো এবং (২০২২ সাল নাগাদ চলমান) প্রায় ৪২ শতাংশ জায়গার উপর ষোল হাজার স্কয়ার ফিটের আন্তর্জাতিক মানের সুবিশাল দৃষ্টিনন্দন পাঁচ তলা মসজিদে রব্বানী নিয়ে জামিআর বর্তমান পরিসর। ‘আলহামদুলিল্লাহ, এ শুধু মহান রব্বুল আলামীনের অশেষ কৃপা ও অনুগ্রহ’— এটাই হযরতের সার্বক্ষণিক সরল স্বীকারোক্তি। এই দরদী মানুষটি দু‘চোখভরা স্বপ্ন ও আশা নিয়ে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, জীবন—যৌবন উৎসর্গ করে একজন দরদী মালীর মতই তিলে তিলে স্বযত্নে সাজিয়েছেন তাঁর রব্বানী কানন। দিন—রাত তাঁর একই স্বপ্ন; একই জপ— “আমি দেখতে চাই, জামিআ রাব্বানিয়া হবে দ্বিতীয় দারুল উলূম দেওবন্দ, সেই আকাবিরের যামানার একটি ফটোকপি।”
হযরত প্রায়ই বলেন, “আলহামদুলিল্লাহ, সব আল্লাহ পাকের দান। আমাদের মুরুব্বীরা জামিআ রাব্বানিয়াকে ভালবাসেন, জামিআর তালীম—তারবিয়াতের প্রশংসা করেন। জামিআর ছাত্ররা কেন্দ্রীয় বোর্ড পরীক্ষায় সাড়া জাগানো ফলাফল করে— এগুলো অনেক বড় নেয়ামত। কিন্তু এতেও আমার আশা পূরণ হয়নি, আমি তো দেখতে চাই এখান থেকে সদর সাহেব হুজুর, হাফেজ্জী হুজুরদের জামাত তৈরি হবে। যেদিন আমি দেখবো, বাংলার দ্বিতীয় শামসুল হক ফরিদপুরী, হাফেজ্জী, পীরজী এখান থেকে পয়দা হয়েছে, সেদিন আমার এই ব্যথিত হৃদয় শান্ত হবে। আল্লাহ পাক যেন আমাকে এ দৃশ্য দেখিয়ে নেন। ” (আমীন)।
আল্লামা ভাসানী শুধু একটি নাম নয়; একটি বিপ্লব, একটি নব জাগরণ। ‘কাসেমীদর্শনের’ আপডেট ভার্সন ‘ভাসানীদর্শন’। এই দর্শন হচ্ছে, একটি ইলমী বিপ্লব, একটি আমলী ইনকিলাব, একটি জাতির পুনঃঅভ্যুত্থান। উপমহাদেশের বুকে আসলাফের রেখে যাওয়া ইলমী আমানত ও আমলী যিন্দেগী সুসংরক্ষণের এক আমরণ সংগ্রাম।
যেমনিভাবে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ আগ্রাসনে ৮শ বছরের মুসলিম ঐতিহ্য ধুলোয় মিশে, গোটা ভারত উপমহাদেশ ছেয়ে গিয়েছিল জাহেলিয়্যাতের ঘোর অন্ধকারে, তখন গুমনাম এক ‘কাসেমীদর্শন’ শুধু ভারতবর্ষ নয়, গোটা পৃথিবীকে আলোকিত করেছিল হেরার দ্যুতি দিয়ে। ঠিক তেমনিভাবে বিংশ শতাব্দীতে মুসলিম সমাজ যখন পশ্চিমাদের বুদ্ধিভিত্তিক পরোক্ষ আগ্রাসনে ধর্মহীনতা, ধর্মান্ধতা, ধর্মদ্রোহিতা ও ধর্মবিভ্রান্তির চোরাবালিতে হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের অতলগহ্বরে, তখন আকাবির ও আসলাফের ভাবধারায় গুমনাম আরেকটি ‘ভাসানীদর্শন’ বাস্তবমুখী, যুগোপযোগী ইলম—আমল, তালীম—তারবিয়াতের সমন্বয়ে, বিদগ্ধ মুহাক্কিক ও আল্লাহওয়ালা, চোখের পানি ও তাকওয়াওয়ালা, যোগ্য—প্রাজ্ঞ—সচেতন ও অভিজ্ঞ আলেমে দ্বীন তৈরির মহা মিশন নিয়ে, ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ, গ্রাম, জেলা, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, সমস্ত বুদ্ধিভিত্তিক আগ্রাসনের মোকাবেলা করে ইসলামের সুন্দর ও সুখময় জীবনব্যবস্থা গড়ে তুলবে। এমন এক সুদূরপ্রসারী নীরব সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন আমাদের এ মহান সাধক।
আল্লাহ পাক হযরতকে দান করেছেন এক অব্যক্ত দরদে নবুওয়ত, বিশেষ রুচিবোধ ও সুক্ষ্মচিন্তা—চেতনা। হযরত লেখাপড়া শেষ করে দেশে আসার পর সর্ব প্রথম কাজ শুরু করেন নিজ এলাকায়। নিজ গ্রামের মানুষদের দীন মুখী করতে প্রথমে যুবকদের নিয়ে একটি কাফেলা তৈরি করেন ‘ফারুকী যুবসমাজ’ নামে নবীজির ‘হিলফুল ফুযুল’ অনুসরণ করে। হযরত তাদেরকে ওয়াজ—নসীহত করতেন। তাদের মাধ্যমে সমবয়সীদের নামাজের দাওয়াত দিতেন। দীন পালনে উদ্বুদ্ধ করতেন। এভাবে মাত্র এক বছরে গ্রামে বিশাল পরিবর্তন আসে। হযরত তাদের শায়েখ ও মুরব্বী হয়ে যান এবং এক বছরের মাথায় নোমানিয়া নামে একটি দীনি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং তা পরিচালনার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। শুধু এটুকুই নয়, জামিআ রাব্বানিয়া যে মহল্লায় অবস্থিত এক সময় সেখানে দীনি পরিবেশ ছিল না; বরং রাব্বানিয়া প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর অনেকে তো ঘোর বিরোধী ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে হযরত অত্যন্ত সুচারুরূপে ধীর পদক্ষেপের মাধ্যমে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এলাকায় এক ভণ্ডপীর আস্তানা গেঁড়ে বসেছিল। সে এমনই প্রভাবশালী ছিল যে, তার বিরুদ্ধে কিছু বলা ও মুশকিল ছিল। কিন্তু আল্লাহ পাকের রহমতে হযরত এমন সুকৌশলে তাকে উৎখাত করেন; সে ‘চুঁচেরা’ করার সুযোগ পায়নি। হযরত এলাকার মানুষের সাথে সুসম্পর্ক করেন। এলাকার রাস্তাঘাট ও কাঠামোগত উন্নতির জন্য কাজ করেন। এমনকি সর্বসম্মতিক্রমে মাদ্রাসার নামের সাথে মিলিয়ে এলাকার নাম ‘রব্বানীনগর’ নির্ধারণ করে দেন। এলাকাবাসীর মাঝে একটি কমিটি গঠন করে দেন, যাতে কেউ এলাকার দ্বীনি পরিবেশের ব্যঘাত ঘটাতে না পারে। এলাকাবাসীর দ্বীনি উন্নতির জন্য প্রতি ইংরেজী মাসের ১ম বৃহস্পতিবার মাসিক ইসলাহী ইজতেমার ব্যবস্থা করেন।
এছাড়া হযরতের আরো অনেক বিষয়ে তাজদীদী কারনামা রয়েছে, যা সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। আসলে আল্লাহ পাক হযরতের মধ্যে ঘটিয়েছেন অপূর্ব গুণাবলীর এক বিস্ময়কর সমাহার। সেই গুণগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে কয়েক ভলিউমের প্রয়োজন। তাই আলোচনা দীর্ঘ না করে হযরতের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্তসহযোগী জামিআ রাব্বানিয়ার স্বনামধন্য নাজেমে তালীমাত ও শায়েখে ছানী, সুক্ষ্ণদর্শী বিজ্ঞ ফকীহ হযরত মাওলানা মুফতী জাহিদুল ইসলাম দামাত বারাকাতুহুমের হযরত সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন ও অভিব্যক্তির কিয়দাংশ উল্লেখ করে আলোচনার ইতি টানছি।
বড় হুজুর এর জিন্দেগীর হালাত, গুণাবলী প্রত্যেকটা বিষয় এতটা পরিপূর্ণ যে, সাধারণ মানুষ তো বটেই বড় থেকে বড় মানুষের জন্যও তা শুধু অনুসরণীয় নয়, বরং ঈর্ষণীয়; বর্তমান যমানার বিবেচনায় অবিশ্বাস্য। যারা হুজুরকে কাছে থেকে দেখেনি তারা বুঝতে পারবে না, এই যামানায় এমন ব্যক্তিও হতে পারে। অনেক মানুষ এমন হয়, দূর থেকে ভালো মনে হয়, কিন্তু কাছে আসলে তার অনেক কিছুইই তিরাজে ভরা থাকে (প্রশ্নবিদ্ধ মনে হয়)। আমরা দীর্ঘ সময় হুজুরের সাথে আছি, হুজুরের গুণাবলীর দিনদিন তারাক্কী—ই দেখতে পাচ্ছি। আমাদের আকাবিরের ব্যাপারে বুযুর্গরা বলে থাকেন, সাহাবায়ে কেরামের জামাত চলছিল, এর মধ্য থেকে একদল পিছে রয়ে গেল, এরাই আকাবিরে দেওবন্দ। বড় হুজুর দামাত বারাকাতুহুম সম্পর্কে যদি সংক্ষেপে বলি, তবে এভাবে বলতে হবে— আকাবিরে দেওবন্দের জামাত চলছিল, এর মধ্য হতে তারা মুফতী নজরুল ইসলাম ভাসানীকে বললেন, সবাই চলে গেলে কেমনে হবে, কাজ তো করতে হবে, তুমি আমাদের পক্ষ থেকে থেকে যাও, আমাদের বাকী কাজগুলো সম্পন্ন করো। এর মাধ্যমেই হুজুরের মাকাম কিছুটা বুঝে নেয়া যায়। খোলাসা কথা হল, বড় হুজুর দামাত বারাকাতুহুম আকাবিরের বাস্তব নমুনা। আকাবিরে দেওবন্দের যে হালাত আমরা শুনি বা পড়ি, তাতে আমার এটাই মনে হয় যে, ‘আকবিররা মুফতী ভাসানীকে রেখে গেছেন’।