প্রতিষ্ঠাতা পরিচিতি

প্রতিষ্ঠাতা পরিচিতি

হযরত মাওলানা মুফতী নজরুল ইসলাম ভাসানী
জামিআ রাব্বানিয়া আরাবিয়ার স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠাতা ‎মুহতামিম মুফতী নজরুল ইসলাম ভাসানী (দামাত ‎বারাকাতুহুম)। এ মহা মনীষীর জীবনচরিতের ‎প্রতিটি ভাঁজেভাঁজে রয়েছে আদর্শ মানুষ হওয়ার ‎অনুপ্রেরণা ও সফল জীবন গঠনের মন্ত্রণা। ‎
জন্ম ও শৈশব:‎
বাংলাদেশের শরীয়তপুর জেলার সদর থানার অন্তর্গত পশ্চিম ভাষানচর গ্রামে ২রা মার্চ ১৯৭৭ ‎ঈসায়ী ‎সনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তিনি নূরানী এক পরিবেশে বেড়ে ওঠেন। তাঁর বাবা ‎ছিলেন ‎নিষ্ঠাবান সৎ ও ধর্মভীরু মানুষ। ইবাদত‎—বন্দেগীর প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল ঈর্ষণীয়। উলামা—‎মাশায়েখকে ‎তিনি ভীষণ মহব্বত করতেন; ‎এলাকায় কোন বুযুর্গের আগমন ঘটলেই তিনি সন্তানদের ‎নিয়ে ছুটে যেতেন ‎তাঁর দুআ আনতে।‎
শিক্ষা:‎
বংশগতভাবেই হযরতের পরিবার ছিল শিক্ষিত, ‎রুচিশীল ও সম্ভ্রান্ত। বাল্যকালে তিনি পঞ্চম শ্রেণী ‎পর্যন্ত ‎ইবতেদায়ী মাদরাসায় পড়াশোনা করেন। এরপর কালকিনী হাফেজিয়া মাদ্রাসায় খুব অল্প সময়ে ‎সুনামের ‎সাথে হিফজুল কুরআন সমাপন করেন। তারপর কিতাব বিভাগে জামালুল কুরআন ‎‎(ঢালকানগর, ‎ঢাকা) ‎মাদরাসায় তাইসীর জামাতে ভর্তি হন। পরবর্তীতে বাইতুল উলূম ঢালকানগর ‎মাদরাসায় কাফিয়া ‎জামাত পর্যন্ত পড়েন। এরপর জামিয়া রাহমানিয়া’য় শরহেজামী জামাতে ভর্তি হয়ে ‎কৃতিত্বের সাথে ‎‎২০০০ সালে দাওরায়ে হাদীস সম্পন্ন করেন।‎
‎২০০১ সালে বসুন্ধরা ইসলামিক রিসার্চ সেন্টারে এক বছর ‎ফিকহ—‎ফতওয়া নিয়ে মেহনত করেন। পরে ‎উচ্চতর শিক্ষা লাভের জন্য ভারতে শাহী মুরাদাবাদে ‎প্রখ্যাত আলেমে দ্বীন মুফতি শাব্বীর আহমদ ‎কাসেমীর তত্ত্বাবধানে ফিকহ ও ফতোয়ার উপর তাখাসসুস ‎করেন।‎
পড়াশোনায় তিনি ছিলেন সর্বসেরা। সবার পরে শুরু করেও সবার আগে হিফযুল কুরআন শেষ ‎করেছিলেন। ‎পুরো ছাত্র ‎যমানায় ‘নাম্বারে আউয়াল’ ছিলেন। ‎রাহমানিয়ার প্রথম পরীক্ষায় ৬ষ্ঠ হওয়ার ‎পর দৃঢ় সংকল্প করেন ‎‎যে, ‎পরের পরীক্ষায় প্রথম না হয়ে মাদ্রাসা থেকে বের হবেন না। এবং পরবর্তী ‎পরীক্ষায় প্রথম স্থান ‎অধিকার করে তবেই তিনি মাদরাসার বাহিরে আসেন।‎
‎উস্তাদদের ‎‎খেদমত আর তাদের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। ক্লাসের ‎‘ফাস্টর্ বয়’ হওয়া সত্ত্বেও তাঁর মনে কোনও অহংকার ছিল না। সাথীদেরকে খুব যত্নের সাথে সবক ‎বুঝিয়ে দিতেন; অত্যন্ত ফিকিরের সাথে চমৎকার পরামর্শ দিতেন। তাই সবার মাঝে তিনি ‘মুশীরে ‎আলা’ ‎‎(প্রধান পরামর্শদাতা) হিসেবে পরিচিত ছিলেন।‎
হযরতের দাওরায়ে হাদীসের বছর রাহমানিয়ায় বড় ধরনের ইখতিলাফ হয়। ‎ছাত্ররা দু‘দলে বিভক্ত হয়ে ‎অভ্যন্তরীন মনোমালিন্য ও বৈরিভাব তৈরি হয়। জামাতের ‎যিম্মাদার হিসেবে তিনি ছাত্রদেরকে বুঝিয়ে ‎নিরপেক্ষ ও মু‘তাদিল অবস্থান স্পষ্ট করেন। ফলে বহু ছাত্র ইখতিলাফ থেকে ফিরে আসে।‎
তাক্বওয়া ও খোদাভীতি:‎
বাড়িতে পরিপূর্ণ শরয়ী পর্দা ছিল না। হযরত তাঁর শায়েখ ‎‎(ঢালকানগরের ‎হযরতওয়ালা দামাত ‎বারাকাতুহুম)—কে গাইরে মাহরামদের বেপর্দার বিষয়টি জানালে তিনি বলেন, “হয় তাদের খুশি ‎করো, ‎না হয় আল্লাহকে ‎খুশি করো!” এরপর তিনি বাড়িতে গিয়ে মায়ের মাধ্যমে গাইরে মাহরামদেরকে ‎সামনে আসতে শক্তভাবে নিষেধ করেন। তখন থেকে তারা আর কখনো তাঁর সামনে আসতে পারেনি।‎ ‎পরিবার ও এলাকার মুসল্লিদের মাঝে তাঁর দীনদারির যথেষ্ট প্রভাব ছিল।‎

জীবনের শুরু থেকেই হযরত আত্মশুদ্ধি অর্জনের প্রতি গুরুত্ব দেন। প্রথমে যাত্রাবাড়ির ‎শায়েখজী হুজুর ‎হযরত মাওলানা সালাহুদ্দীন সাহেব (রহমাতুল্লাহি আলাইহি)—এর সাথে এবং পরবর্তীতে ঢালকানগরের ‎হযরতওয়ালার সঙ্গে‎ ইসলাহী সম্পর্ক ‎কায়েম করেন।‎
সব সময় তিনি সুন্নত ও তাক্বওয়ার সাথে থাকতেন। বিশেষ করে ‎সুশ্রী ছেলেদের থেকে অত্যন্ত পরহেয ‎করতেন। একবার ‎একজন সুশ্রী (মেধাবী ছাত্রের) বিছানা হযরতের পাশে দেয়া হলে তিনি খুবই ‎‎পেরেশান হয়ে যান। ‎‎কোন সমাধান না পেয়ে তাঁর শায়েখের পরামর্শে নিজের স্পেশাল ‎জায়গাটি ছেড়ে ‎দিয়ে দরজার পাশে চলে আসেন। তাঁর এ নূরানী জীবনধারার কারণে ছাত্রযামানা ‎‎থেকেই সাথীরা তাঁকে ‎‘শায়েখ’, ‘পীরসাহেব’ বলে সমীহ করতো।‎
হযরতের সহপাঠী ও সহকর্মীরা অকপটেই একথা স্বীকার করেন যে, ‎তিনি ‎একজন ‘মাদারযাদ ওলী’ ‎‎(জন্মগত বুযুর্গ)। এই স্বভাবজাত তাকওয়া—খোদাভীতি ও উন্নত ‎আখলাক—‎চরিত্রের কারণে তাঁর প্রাণপ্রিয় ‎শায়েখ ও মুর্শিদ আরেফবিল্লাহ, রুমীয়ে যামানা, ‎আল্লামা ‎শাহ আব্দুল মতীন বিন হুসাইন হযরতওয়ালা ‎ঢালকানগরী (দামাত বারাকাতুহুম) ছাত্র ‎যমানাতেই ‎‎(দাওরায়ে হাদীসের বছরের শেষে) অত্যন্ত জোশ ও ‎আবেগের সাথে তাঁকে সর্বপ্রথম ‎‘ইজাযত’ ‎দানে ধন্য করেন।‎
বুযুর্গদের সোহবত:‎
‎আমাদের দেশের বেশীর ভাগ আকাবিরে দীনের সোহবত ও শিষ্যত্ব লাভ করেছেন তিনি। ‎বিশেষভাবে ‎শায়েখজী হুজুর সালাহুদ্দীন সাহেব, ঢাকুবী হুজুর আব্দুল মজীদ সাহেব, ‎শাইখুল হাদীস ‎আজীজুল হক ‎সাহেব, ফকীহুল মিল্লাত মুফতী আব্দুর রহমান সাহেব, ‎হযরত মাওলানা হেদায়াতুল্লাহ ‎মুহাদ্দিস সাহেব ‎‎(রহমাতুল্লাহি আলাইহিম)—সহ অনেক বুযুর্গানে দীনের শিষ্যত্ব ও খাস সোহবত লাভে ‎ধন্য হন তিনি। ‎
ভারতের শাহী মুরাদাবাদে থাকা অবস্থায় কুরবানীর ছুটিতে পুরো আট দিন মহিউসসুন্নাহ হযরত ‎মাওলানা ‎আবরারুল হক সাহেব রহ. ‎এর একেবারে খাস সোহবত ও বিশেষ ফয়েয লাভে ধন্য হন। ‎এছাড়া, ‎শাইখুল হাদীস যাকারিয়া রহ. ‎এর বিশিষ্ট শাগরেদ, সাহারানপুর মাদরাসার আমরণ শাইখুল ‎হাদীস ‎ইউনুস পালনপুরী রহ., ‎আরেফ বিল্লাহ রুমিয়ে যামানা হযরত মাওলানা শাহ হাকীম মুহম্মাদ ‎আখতার ‎হযরতওয়ালা করাচী রহ.‎—সহ তৎকালীন হিন্দুস্তান ও পাকিস্তানের বড় বড় ওলামা—‎মাশায়েখের ‎বিশেষ ‎সান্নিধ্য ও নেক নযর লাভ করেন। ‎
হযরত বলেন, ‎‘আল্লাহ পাকের খাস মেহেরবানী, একেবারে ‎‎ছোটবেলা থেকেই আমি বুযুর্গানে দীনের ‎‎নেক নযর ও তাদের সোহবতে বড় হয়েছি। এ কারণে তাসাউফ কেমন ‎‎যেন আমার রগ—রেশায় ‎একেবারে মিশে গেছে।’‎
কর্মজীবন:‎
‏‏ভারত‏ ‏‎থেকে‎‏ ‏তাখাসসুস‏ ‏সম্পন্ন‏ ‏করে‏ ‏আসার‏ ‏পর‏ ‏প্রথম‏ ‏বছর ‎‎“দারুল‏ ‏ফিকরি‏ ‏ওয়াল‏ ‏ইরশাদে”‏ ‏মুফতী‏ ‏আবু‏ ‏সাঈদ‎‏ ‏সাহেব‏ ‏হুজুরের‏ ‏মুঈন‏ ‏হিসেবে‏ ‏এক‏ ‏বছর‏ ‏ফিকহ‏—‏‏ফতোয়ার‏ ‏‎খেদমত‎‏ ‏করেন।‎‏ ‏এরপর‏ ‏দ্বিতীয়‏ ‏বছর‏ ‏‎দরস‎‏—‏‏তাদরীসের‏ ‏‎খেদমত‎‏ ‏শুরু‏ ‏করেন ‎‎‘মারকাযুল‏ ‏উলূম‏ ‏মুগদা‏ ‏মাদরাসা’য়। অত্যন্ত সুমামের সাথে সেখানে এক ‎বছর খেদমত আঞ্জাম দেন।  ‎কিন্তু‎‏ ‏ ‏ঘটনাক্রমে‏ ‏‎সেই‎‏ ‏মাদ্রাসার‏ ‏কিছু‏ ‏বিষয়‏ ‏হযরতের‏ ‏তাহকীক‏ ‏অনুযায়ী‏ ‏শরীয়তসম্মত‏ ‏না‏ ‏হওয়ায়,‎‏ ‏ ‏অত্য‎ন্ত‏ ‏শ্রদ্ধা‏ ‏ও‏ ‏হিকমতের‏ ‏সাথে‎‏ ‏তিনি সেখান থেকে সরে আসেন। ‎‏ ‏
‎সে‎‏ ‏বছরেই‏ ‏হযরতের‏ ‏কাছে‏ ‏বড়‏ ‏বড়‏ ‏জামিআ‏ ‏‎থেকে‎‏ ‏প্রস্তাব‏ ‏আসে, ‎তখন‏ ‏তিনি‏ ‏মুরুব্বিদের‏ ‏সাথে‎‏ ‏পরামর্শ‎‏ ‏করে ‎‎‘ইশায়াতুল‏ ‏উলূম‏ ‏যাত্রাবাড়ি‏ ‏মাদরাসা’য়‏ ‏‎খেদমত‎‏ ‏শুরু‏ ‏করেন‎।‎‏
জামিআ রাব্বানিয়া প্রতিষ্ঠা:‎
‏গতানুগতিক ধারার মাদরাসাগুলোর‏ ‏অন্তসারশূণ্য‎‏ ‏ব্যবস্থাপনার‏ ‏ফলে‏ ‏ইলমে‏ ‏‎দীনের‎‏ ‏‎দৈন্যদশা, অযত্ন—‎‎‎অবহেলা‏ ‏আর‏ ‏সঠিক‏ ‏তারবিয়াত‏ ‏ও‏ ‏পরিচর্যার‏ ‏অভাবে‏ ‏সুপ্ত‏ ‏প্রতিভার‏ ‏অধিকারী‏ ‏হাজারো‏ ‏‎মেধাবীদের‎‏ ‏হারিে‎য়‏ ‏যাওয়া—‎‏ ‏‎দেখে‎‏ ‏হযরত‏ ‏সর্বক্ষণ‏ ‏‎দগ্ধ‎‏ ‏হতেন‏ ‏অব্যক্ত‎‏ ‏এক‏ ‏আত্মদহনে।‎‏ ‏তিনি‏ ‏শিক্ষাজীবন‏ ‏‎থেকেই‎‏ ‏‎স্বপ্ন‎‏ ‏‎দেখতেন, ‎যি‎দ‎‏ ‏এমন‏ ‏‎কোন‎‏ ‏জামিআ‏ ‏‎থাকতো, যেখানে ‎‏হবে‏ ‏ইলম‏ ‏ও‏ ‏আমল, ‎তালীম‏ ‏ও‏ ‏তরবিয়াতের‏ ‏মিলন‏ ‏‎মেলা।‎‏ ‏যার‏ ‏তালিবুল‏ ‏ইলমরা‏ ‏হবে‏ ‏বিদগ্ধ‎‏ ‏মুহাক্কিক‏ ‏ও‏ ‏আল্লাহওয়ালা।‎
সময়‏ ‏যত‏ ‏যাচ্ছিল, ‎এ‏ ‏যাতনা‏ ‏তত‏ ‏তীব্র‎‏ ‏‎থেকে‎‏ ‏তীব্রতর‏ ‏ও‏ ‏অসহনীয়‏ ‏হয়ে‏ ‏উঠছিল।‎‏ ‏হযরতের‏ ‏অধ্যাপনার‏ ‏তখন ৩য়‎‏ ‏বছর‏ ‏ ‏চলছিল‏ ‏‎।‎‏ ‏হযরত‏ ‏নিজ‏ ‏মুরুব্বি‏ ‏ও‏ ‏শায়েখ‏ ‏ঢালকানগরের‏ ‏হযরতওয়ালা ‎‎(দামাত‎‏ ‏বারাকাতুহুম) ‎এর‏ ‏কাছে‏ ‏এ‏ ‏অব্যক্ত‎‏ ‏যাতনার‏ ‏কথা‏ ‏ব্যক্ত‎‏ ‏করেন।‎‏ ‏হযরতওয়ালা‏ ‏সব‏ ‏শুনে‏ ‏কিছুক্ষণ‏ ‏ধ্যান—‎‎মৌন‎‏ ‏‎থেকে‎‏ ‏‎দরাজ‎‏ ‏কন্ঠে‏ ‏বলেন, ‎যাও “তাওয়াক্কুলানআলাল্লাহ” (আল্লাহর উপর ভরসা করে শুরু ‎করো!) ‎সুবহানাল্লাহ! ‎না জানি কোন আসমানী ইশারা পেয়ে এতটা দীপ্ত কন্ঠে অনুমতি প্রদান ‎করেছিলেন ‎তিনি। এভাবেই শুরু হয় জামিআ রাব্বানিয়ার শুভযাত্রা। ‎

অদম্য আত্মবিশ্বাস, তাকওয়াপূর্ণ সৎ সাহস, ইখলাসে ভরপুর সুদৃঢ় পদক্ষেপ, লক্ষ্য জয়ের দুর্বারগতি ‎সর্বোপরি, ‎তাওয়াক্কুল ও চোখের পানি হযরতের জীবনের উজ্জ্বল কিছু শিরোনাম। হযরত প্রায়ই বলেন,  ‎“আল্লাহর ফয়সালা ছাড়া কিছুই হয় না—‎এই বিশ্বাস তো আছে। সুতরাং আমি নেব আসমানওয়ালার কাছ ‎‎থেকে। যার কাছে এক টাকা আর এক কোটি টাকা সমান। দুনিয়ার বাজার মন্দা থাকতে পারে, তাঁর ‎ভাণ্ডারে কোন মন্দা নেই। কীভাবে কী ব্যবস্থা হবে, ‎আমি তা জানি না। তবে এতটুকু জানি, তাঁর মঞ্জুরি ‎হলে সব হয়ে যাবে। তিনি যেভাবে চান, ‎সেভাবেই হবে। সুতরাং আমার কাজ হল, ‎তাঁর সাথে গভীর ‎‎থেকে গভীরতম সম্পর্ক করা আর নিজের সাধ্যের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করা।”
এমনকি হযরতের আসাতি‎যায়ে কেরাম পর্যন্ত বলেন— ‘ও (হযরত) ‎আল্লাহর কাছ থেকে সব চেয়ে ‎নিয়েছে’। হযরতের খাস উস্তাদ মুফতী মানসূরুল হক সাহেব (দামাত বারাকাতুহুম) ‎বলেন, ‘আমরা ছাত্র ‎যামানায় ধারণা করেছিলাম, ওর দ্বারা বড় কোন কাজ হবে।’ সত্যি বলতে কী, ‎শুধু কথার ফুলঝুরিতে ‎নয়; বাস্তবেই যার জীবন—দর্শন এমন, ‎তাকে ঠেকাতে পারে এমন কোন শক্তি নেই প্রভুর কুদরত ছাড়া। ‎তাই তো নিঃস্ব, ‎নিঃসম্বল ও রিক্ত হস্তেই হযরত জামিআ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নেমে গেলেন একমাত্র মহান ‎প্রভুর উপর গভীর ভরসা ও বিশ্বাসের শক্তি নিয়ে। ২০০৫ সালের জেএমবির বোমা হামলার কারনে, ‎‎দেশ জুড়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে অনেক কষ্টে একটি ভাড়া বাড়ি পেলেন, ‎ভাড়ার বায়নাও করলেন ঋণ করে; নির্ভয়ে, ‎ইখলাস ও তাওয়াক্কুলের রক্ষাকবচ নিয়ে।‎
হযরতের সহকর্মীরা বলেন, ‎বড় হুজুরের মাঝে আল্লাহ পাক এমন হিম্মত ও ফিকির দান করেছেন যা ‎সত্যিই অকল্পনীয়। হযরতের তাখাসসুসের উস্তাদ মুফতী সালমান মানসূরপুরী (ভারত) দামাত ‎বারাকাতুহুমতো এভাবে বলেছেন ‎یہ تو ہمت کا پہاڑ ‏ہے‎ ‘এ ছেলেটি তো হিম্মতের পাহাড়’! হযরতের উস্তাদ ‎মুফতী শাব্বীর আহমাদ কাসেমীর (ভারত) ‎মত বিদগ্ধ আলেম হযরত সম্পর্কে শাহী মুরাদাবাদে ‎উস্তাদদের মিটিংয়ে বলেছিলেন ‎یہ طالب علم بہت محنتی ‏ہے‎ এ তালেবে ইলম খুবই মেহনতী।‎
‎২০০৫—২০২০। সেই কষ্ট পূর্ণ জীর্ণশীর্ণ ভাড়া বাড়ির রাব্বানিয়া মাত্র পনের বছরের ব্যবধানে আজ প্রায় ‎চার বিঘা জায়গা জুড়ে সাড়ে ছয় হাজার স্কয়ার ফিটের দৃষ্টি নন্দন সুপ্রশস্ত অত্যাধুনিক সাত তলা ভবন ও ‎একটি তিন তলা ভবনসহ অন্যান্য অবকাঠামো এবং (২০২২ সাল নাগাদ চলমান) ‎প্রায় ৪২ শতাংশ ‎জায়গার উপর ষোল হাজার স্কয়ার ফিটের আন্তর্জাতিক মানের সুবিশাল দৃষ্টিনন্দন পাঁচ তলা মসজিদে ‎রব্বানী নিয়ে জামিআর বর্তমান পরিসর। ‘আলহামদুলিল্লাহ, এ শুধু মহান রব্বুল আলামীনের অশেষ কৃপা ‎ও অনুগ্রহ’— ‎এটাই হযরতের সার্বক্ষণিক সরল স্বীকারোক্তি। এই দরদী মানুষটি দু‘চোখভরা স্বপ্ন ও আশা ‎নিয়ে, ‎মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, জীবন—‎যৌবন উৎসর্গ করে একজন দরদী মালীর মতই তিলে তিলে ‎‎স্বযত্নে সাজিয়েছেন তাঁর রব্বানী কানন। দিন—‎রাত তাঁর একই স্বপ্ন; একই জপ— “আমি দেখতে চাই, ‎জামিআ রাব্বানিয়া হবে দ্বিতীয় দারুল উলূম দেওবন্দ, ‎সেই আকাবিরের যামানার একটি ফটোকপি।”
হযরত প্রায়ই বলেন, “আলহামদুলিল্লাহ, ‎সব আল্লাহ পাকের দান। আমাদের মুরুব্বীরা জামিআ ‎রাব্বানিয়াকে ভালবাসেন, জামিআর তালীম—‎তারবিয়াতের প্রশংসা করেন। জামিআর ছাত্ররা কেন্দ্রীয় ‎‎বোর্ড পরীক্ষায় সাড়া জাগানো ফলাফল করে— ‎এগুলো অনেক বড় নেয়ামত। কিন্তু এতেও আমার আশা ‎পূরণ হয়নি,  আমি তো দেখতে চাই এখান থেকে সদর সাহেব হুজুর, ‎হাফেজ্জী হুজুরদের জামাত তৈরি ‎হবে। যেদিন আমি দেখবো, বাংলার দ্বিতীয় শামসুল হক ফরিদপুরী, হাফেজ্জী, ‎পীরজী এখান থেকে ‎পয়দা হয়েছে, ‎সেদিন আমার এই ব্যথিত হৃদয় শান্ত হবে। আল্লাহ পাক যেন আমাকে এ দৃশ্য দেখিয়ে ‎‎নেন। ” (আমীন)।‎
আল্লামা ভাসানী শুধু একটি নাম নয়; একটি বিপ্লব, একটি নব জাগরণ। ‘কাসেমীদর্শনের’ ‎আপডেট ‎ভার্সন ‘ভাসানীদর্শন’। এই দর্শন হচ্ছে, একটি ইলমী বিপ্লব, একটি আমলী ইনকিলাব, ‎একটি জাতির ‎পুনঃঅভ্যুত্থান। উপমহাদেশের বুকে আসলাফের রেখে যাওয়া ইলমী আমানত ও আমলী যিন্দেগী ‎সুসংরক্ষণের এক আমরণ সংগ্রাম।‎
‎যেমনিভাবে ইংরেজদের প্রত্যক্ষ আগ্রাসনে ৮শ বছরের মুসলিম ঐতিহ্য ধুলোয় মিশে, ‎গোটা ভারত ‎উপমহাদেশ ছেয়ে গিয়েছিল জাহেলিয়্যাতের ঘোর অন্ধকারে, তখন গুমনাম এক ‘কাসেমীদর্শন’ ‎শুধু ‎ভারতবর্ষ নয়, ‎গোটা পৃথিবীকে আলোকিত করেছিল হেরার দ্যুতি দিয়ে। ঠিক তেমনিভাবে বিংশ ‎শতাব্দীতে মুসলিম সমাজ যখন পশ্চিমাদের বুদ্ধিভিত্তিক পরোক্ষ আগ্রাসনে ধর্মহীনতা, ‎ধর্মান্ধতা, ‎ধর্মদ্রোহিতা ও ধর্মবিভ্রান্তির চোরাবালিতে হারিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের অতলগহ্বরে, ‎তখন ‎আকাবির ও আসলাফের ভাবধারায় গুমনাম আরেকটি ‘ভাসানীদর্শন’ বাস্তবমুখী, যুগোপযোগী ইলম—‎আমল, ‎তালীম—তারবিয়াতের সমন্বয়ে, বিদগ্ধ মুহাক্কিক ও আল্লাহওয়ালা, চোখের পানি ও ‎তাকওয়াওয়ালা, ‎যোগ্য—প্রাজ্ঞ—সচেতন ও অভিজ্ঞ আলেমে দ্বীন তৈরির মহা মিশন নিয়ে, ব্যক্তি পর্যায় ‎‎থেকে শুরু করে পরিবার, সমাজ, ‎গ্রাম, জেলা, রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে, ‎সমস্ত বুদ্ধিভিত্তিক ‎আগ্রাসনের মোকাবেলা করে ইসলামের সুন্দর ও সুখময় জীবনব্যবস্থা গড়ে তুলবে। এমন এক ‎সুদূরপ্র‎সারী নীরব সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন আমাদের এ মহান সাধক।‎
আল্লাহ পাক হযরতকে দান করেছেন এক অব্যক্ত দরদে নবুওয়ত, বিশেষ রুচিবোধ ও সুক্ষ্মচিন্তা—‎‎চেতনা। হযরত লেখাপড়া শেষ করে দেশে আসার পর সর্ব প্রথম কাজ শুরু করেন নিজ এলাকায়। নিজ ‎গ্রামের মানুষদের দীন মুখী করতে প্রথমে যুবকদের নিয়ে একটি কাফেলা তৈরি করেন ‘ফারুকী ‎যুবসমাজ’ নামে নবীজির ‎‎‘হিলফুল ফুযুল’ অনুসরণ করে। হযরত তাদেরকে ওয়াজ—‎নসীহত করতেন। ‎তাদের মাধ্যমে সমবয়সীদের নামাজের দাওয়াত দিতেন। দীন পালনে উদ্বুদ্ধ করতেন। এভাবে মাত্র ‎এক বছরে গ্রামে বিশাল পরিবর্তন আসে। হযরত তাদের শায়েখ ও মুরব্বী হয়ে যান এবং এক বছরের ‎মাথায় নোমানিয়া নামে একটি দীনি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন এবং তা পরিচালনার জন্য একটি কমিটি ‎গঠন করেন। শুধু এটুকুই নয়, ‎জামিআ রাব্বানিয়া যে মহল্লায় অবস্থিত এক সময় সেখানে দীনি  পরিবেশ ‎ছিল না; ‎বরং রাব্বানিয়া প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর অনেকে তো ঘোর বিরোধী ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে হযরত ‎অত্যন্ত সুচারুরূপে ধীর পদক্ষেপের মাধ্যমে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। এলাকায় এক ভণ্ডপীর ‎আস্তানা গেঁড়ে বসেছিল। সে এমনই প্রভাবশালী ছিল যে, ‎তার বিরুদ্ধে কিছু বলা ও মুশকিল ছিল। কিন্তু ‎আল্লাহ পাকের রহমতে হযরত এমন সুকৌশলে তাকে উৎখাত করেন; সে ‎‎‘চুঁচেরা’ করার সুযোগ পায়নি। ‎হযরত এলাকার মানুষের সাথে সুসম্পর্ক করেন। এলাকার রাস্তাঘাট ও কাঠামোগত উন্নতির জন্য কাজ ‎করেন। এমনকি সর্বসম্মতিক্রমে মাদ্রাসার নামের সাথে মিলিয়ে এলাকার নাম ‎‎‘রব্বানীনগর’ নির্ধারণ করে ‎‎দেন। এলাকাবাসীর মাঝে একটি কমিটি গঠন করে দেন, ‎যাতে কেউ এলাকার দ্বীনি পরিবেশের ব্যঘাত ‎ঘটাতে না পারে। এলাকাবাসীর দ্বীনি উন্নতির জন্য প্রতি ইংরেজী মাসের ১ম বৃহস্পতিবার মাসিক ‎ইসলাহী ইজতেমার ব্যবস্থা করেন।‎
এছাড়া হযরতের আরো অনেক বিষয়ে তাজদীদী কারনামা রয়েছে, ‎যা সংক্ষিপ্ত বর্ণনায় ফুটিয়ে তোলা ‎সম্ভব নয়। আসলে আল্লাহ পাক হযরতের মধ্যে ঘটিয়েছেন অপূর্ব গুণাবলীর এক বিস্ময়কর সমাহার। ‎‎সেই গুণগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে কয়েক ভলিউমের প্রয়োজন। তাই আলোচনা দীর্ঘ ‎না ক‎রে হযরতের দীর্ঘদিনের বিশ্বস্তসহযোগী জামিআ রাব্বানিয়ার স্বনামধন্য নাজেমে তালীমাত ও ‎শায়েখে ছানী, সুক্ষ্ণদর্শী বিজ্ঞ ফকীহ হযরত মাওলানা মুফতী জাহিদুল ইসলাম দামাত বারাকাতুহুমের ‎হযরত সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন ও অভিব্যক্তির কিয়দাংশ উল্লেখ করে আলোচনার ইতি ‎টানছি।‎
বড় হুজুর এর জিন্দেগীর হালাত, গুণাবলী প্রত্যেকটা বিষয় এতটা পরিপূর্ণ যে, সাধারণ মানুষ তো বটেই ‎বড় থেকে বড় মানুষের জন্যও তা শুধু অনুসরণীয় নয়, বরং ঈর্ষণীয়; ‎বর্তমান যমানার বিবেচনায় ‎অবিশ্বাস্য। যারা হুজুরকে কাছে থেকে দেখেনি তারা বুঝতে পারবে না, ‎এই যামানায় এমন ব্যক্তিও ‎হতে পারে। অনেক মানুষ এমন হয়, দূর থেকে ভালো মনে হয়, ‎কিন্তু কাছে আসলে তার অনেক ‎কিছুইই তিরাজে ভরা থাকে (প্রশ্নবিদ্ধ মনে হয়)। আমরা দীর্ঘ সময় হুজুরের সাথে আছি, ‎হুজুরের ‎‎গুণাবলীর দিনদিন তারাক্কী—ই দেখতে পাচ্ছি। আমাদের আকাবিরের ব্যাপারে বুযুর্গরা বলে ‎‎থাকেন, ‎সাহাবায়ে কেরামের জামাত চলছিল, এর মধ্য থেকে একদল পিছে রয়ে গেল, ‎এরাই আকাবিরে ‎‎দেওবন্দ। বড় হুজুর দামাত বারাকাতুহুম সম্পর্কে যদি সংক্ষেপে বলি, তবে এভাবে বলতে হবে—‎‎ ‎আকাবিরে দেওবন্দের জামাত চলছিল, এর মধ্য হতে তারা মুফতী নজরুল ইসলাম ভাসানীকে ‎বললেন, ‎সবাই চলে গেলে কেমনে হবে, কাজ তো করতে হবে, তুমি আমাদের পক্ষ থেকে থেকে ‎যাও, ‎আমাদের বাকী কাজগুলো সম্পন্ন করো। এর মাধ্যমেই হুজুরের মাকাম কিছুটা বুঝে নেয়া যায়। ‎‎খোলাসা কথা হল, ‎বড় হুজুর দামাত বারাকাতুহুম আকাবিরের বাস্তব নমুনা। আকাবিরে দেওবন্দের যে ‎হালাত আমরা শুনি বা পড়ি, ‎তাতে আমার এটাই মনে হয় যে, ‘আকবিররা মুফতী ভাসানীকে রেখে ‎‎গেছেন’।‎

arrow_upward