জামিআ পরিচিতি
জামিআ রাব্বানিয়া আরাবিয়া। একটি প্রতিষ্ঠান, একটি চেতনা, একটি আন্দোলন। তিমির রজনীর প্রদীপ্ত মশাল, গোমরাহীর আঁধারে হেদায়েতের আলোকবর্তিকা, অপসংস্কৃতির এই ভরা যৌবনে সুস্থ সংস্কৃতিচর্চার প্রাণকেন্দ্র। সর্বোপরি চিরশাশ্বত ধর্ম ইসলামের এক মজবুত নিশ্ছিদ্র দূর্গ। জামিআ রাব্বানিয়া আরাবিয়া ইংরেজ খেদাও আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠিত ঐতিহাসিক দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষাধারায় পরিচালিত একটি ইলমী প্রতিষ্ঠান। তবে এই জামিআ আদর্শ বিবর্জিত নামসর্বস্ব, গতানুগতিক কোন প্রতিষ্ঠান নয়, বরং এটি আপন স্বকীয়তায় উদ্ভাসিত বাস্তবসমুখী সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত এক দ্বীনী মারকায।
সূচনার প্রেক্ষাপট
জামিআ রাব্বানিয়া এক ব্যথার দান, সুদীর্ঘ ফিকির ও দরদে দিলের বহিঃপ্রকাশ। এ অব্যক্ত যন্ত্রণা ও দিলের তড়প পার্থিব কোন মোহ-মায়াকে কেন্দ্র করে নয়। নয় কোন পদ-পদবীর বাসনায় কিংবা নিজেকে মেলে ধরার স্বপ্নবিলাসের নেশায়। বরং এ ব্যথা দ্বীনের জন্য, এ দরদ ইলমের জন্য। গতানুগতিক বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অন্তসারশূন্য ব্যবস্থাপনার ফলে ইলমের দৈন্যদশায় যিনি মর্মাহত হতেন প্রতিনিয়ত। অবহেলা-অযত্ন আর সঠিক পরিচর্যার অভাবে সুপ্ত প্রতিভার অধিকারী বহু মেধাবীদের হারিয়ে যাওয়া যাকে চরম পীড়া দিতো, তিনি হচ্ছেন ইলমী কাননের দরদী মালী, এই জামিআর প্রাণপুরুষ, প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম মুফতী নজরুল ইসলাম ভাসানী (বড় হুজুর দামাত বারাকাতুহুম)। শিক্ষাজীবনেই তিনি মনের গহীনকোণে সুপ্ত বাসনা লালন করতেন- আহা! যদি আবার এমন কোন দ্বীনী প্রতিষ্ঠান কায়েম হতো, যার শিক্ষার্থীরা ইলমের নেশায় বিভোর থাকবে। যারা হবে জ্ঞান-সাগরের ডুবুরি। দ্বীন প্রতিষ্ঠায় যারা নিজেদেরকে গড়ে তুলবে মর্দে মুজাহিদ রূপে। যেখান থেকে আবিভূর্ত হবে এমন একদল যোগ্য নায়েবে রাসূল, যারা কুরআন-সুন্নাহ তথা ধর্মীয় জ্ঞানে গভীর পান্ডিত্যের পাশাপাশি তাকওয়া-তাহারাত, যুহদ ও পরহেজগারিতে পরিণত হবে সোনার মানুষে! বেশ-ভূষা, চাল-চলন, আচরণ-উচ্চারণ এবং আদব-শিষ্টাচারে যারা হবে সালাফের বাস্তব নমুনা। জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইলম ও হেকমতে যারা হবে আকাবিরের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি!
হযরত বড় হুজুর দামাত বারাকাতুহুমের অধ্যাপনার তৃতীয় বছর চলছিল। দীর্ঘদিনের এই আকাঙ্ক্ষা তখন আরো বেগবান ও ঘনীভূত হলো। তাই তিনি তাঁর জীবনের আধ্যাত্মিক রাহবার যুগশ্রেষ্ঠ বুযুর্গ আরেফ বিল্লাহ আল্লামা শাহ আব্দুল মতীন বিন হুসাইন হযরতওয়ালা ঢালকানগরী (দামাত বারাকাতুহুম) এর খেদমতে এই পূণ্যময় ইচ্ছাটি স্ববিনয়ে ব্যক্ত করলেন। হযরত আকাঙ্ক্ষার কথা শ্রবণ করে কিছুক্ষণ ধ্যান-মৌন হয়ে রইলেন। অতপর মাথা তুলে দরাজ কণ্ঠে বলে উঠলেন, যাও "তাওয়াক্কুলান আলাল্লাহ" (তথা আল্লাহর উপর ভরসা করে) শুরু করো। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, হযরতওয়ালা হয়তো ধ্যান-মমতায় আসমানী কোন ইশারা পেয়েই এতটা দীপ্ত কণ্ঠে অনুমতি প্রদান করেছিলেন।
যেভাবে সূচনা
আধ্যাত্মিক মুরব্বীর স্বতঃস্ফূর্ত অনুমতি পেয়ে হযরত বড় হুজুর বেরিয়ে পড়লেন মাদরাসার জন্য ভাড়া বাড়ীর অনুসন্ধানে। কিন্তু সময়টা ছিল বড়ই নাজুক। ২০০৫ সাল। যখন ইসলামের পূণ্যময় বিধান জিহাদের নাম ভাঙ্গিয়ে ’জেএমবি গ্রুপ‘ সারা দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েমের লক্ষ্যে তেষট্টি জেলায় একযোগে সিরিজ বোমা হামলা পরিচালনা করেছিল। বিভিন্ন ক্ষেত্রে উলামায়ে কেরাম তখন চরম হেনস্থার শিকার হচ্ছিলেন। আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থীদের প্রতি জনসাধারণের ছিল তীর্যক দৃষ্টি। এমন নাযুক পরিস্থিতিতে মাদরাসার জন্য বাড়ী ভাড়া পাওয়াটা ছিল দুঃসাধ্য ব্যপার। কোনো বাড়ীর ব্যাপারে আলোচনা হলেও, মাদরাসার কথা শুনলে মালিক পিছু হটে যেতো। এরপরও অনুসন্ধান অব্যাহত থাকে। কখনো কখনো হযরত থমকে যেতেন। মাদরাসা করার স্বপ্ন হতাশায় ছেয়ে যেতো। আশার প্রদীপ নিভু নিভু করতো। কিন্তু হযরতের বন্ধুবর, পীর সাহেব ঢালকানগর (দামাত বারাকাতুহুম) এর বিশিষ্ট খলীফা, মাওলানা তৈয়ব আশরাফ সাহেবের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় আবারো নবোদ্যম ফিরে পেতেন।
সময় বয়ে চলছে আপন গতিতে, কিন্তু বহুদিনের লালিত স্বপ্ন যে অধরাই থেকে যাচ্ছে। যেখানে রমজানের পরপরই মূল কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করার ইচ্ছা, সেখানে রমজানের প্রথম দশক অতিক্রম করে দ্বিতীয় দশক উপনীত, কিন্তু এখনো বাড়ীর কোনও ব্যবস্থা হচ্ছে না। আসলে, কল্যাণকর ও মঙ্গলজনক কোন কাজই আসমানী ইশারা ছাড়া হয় না, হতে পারে না। মহান আল্লাহ পাক যখন যা যেভাবে সম্পাদন করার ইচ্ছা করেন, ঠিক তখন তা সেভাবেই সম্পাদিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রেও এর কোন ব্যত্যয় ঘটলো না। এরই মাঝে একদিন হযরতের খাস দোস্ত মেরাজনগর মাদরাসার সুযোগ্য মুহাদ্দিস মাওলানা মুজিব সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ। হযরত তাঁর কাছে হৃদয়ের আকুতি ব্যক্ত করলেন। তখন তিনি বলে উঠলেন, আমার জানা মতে যাত্রাবাড়ীর মাতুআইলস্থ উত্তর রায়েরবাগ দোতলা মসজিদ সংলগ্ন একটি টিনশেড বাড়ী রয়েছে। বাড়ীর মালিক একজন আলেমে দ্বীন, মাদরাসার জন্য ভাড়া দিতে অত্যন্ত আগ্রহী। একথা শুনে হুজুর কিছুটা আশান্বিত হলেন। অতপর ২২শে রমজান মীর হাজীর বাগে বাড়ীওয়ালার বন্ধু জনাব মাওলানা নেয়ামতুল্লাহ সাহেবের মসজিদ সংলগ্ন হুজরায় হযরত মুহতামিম সাহেব, মাওলানা মুজিব সাহেবসহ মোট চার জন বাড়ী ভাড়া-চুক্তি সম্পাদনের উদ্দেশ্যে একত্রিত হলেন। পাঁচহাজার টাকা অগ্রীম বায়না দিয়ে চুক্তি সম্পন্ন হলো। বায়নার সেই পাঁচ হাজার টাকা ঋণ হিসেবে প্রদান করেছিলেন হযরতের বন্ধুবর জনাব আলহাজ্ব ইসমাইল বাদামতলী সাহেব। অবশ্য পরবর্তীতে সেই টাকা তিনি আর ফেরত নেননি, মাদরাসায় দানের নিয়ত করে নিয়েছেন। প্রতিষ্ঠাকালীন সেই শুভ সময়ে প্রদত্ত এই অর্থকে আল্লাহ পাক তাঁর নাজাতের ওয়াসিলা বানিয়ে দিন। আমীন!
কার্যক্রম শুরু
মোটামুটি প্রস্তুতি নিয়েই রমজান শেষে ৮ই শাওয়াল ভর্তি কার্যক্রম শুরু হলো। মকতব, হিফয এবং কিতাব বিভাগের নাহবেমীর জামাত পর্যন্ত ভর্তি নেওয়া হলো। মহান আল্লাহ পাকের কী যে মেহেরবানী, প্রত্যেক বিভাগেই কল্পনাতীত সংখ্যক ছাত্র ভর্তি হয়ে গেলো। টিনশেডটি ছিল পাঁচ রুম বিশিষ্ট।সামনে উঠান সদৃশ একটি উন্মুক্ত জায়গা ছিল। ছাত্রদের জায়গা সংকুলান না হওয়ায় বছরের শুরুতেই টিনশেডের সাথে একটি বারান্দা সংযুক্ত করতে হলো। সকল বিভাগেই যোগ্য থেকে যোগ্যতর উস্তাদ নিয়োগ দেওয়া হলো।কিতাব বিভাগে নিয়োগ দেয়া হলো ঢালকানগর পীর সাহেবের স্নেহধন্য খলীফা মাওলানা আবদুর রহমান শরীয়তপুরী (দামাত বারাকাতুহুম) কে। তিনি অত্যন্ত ইখলাস ও আন্তরিকতার সাথে যাবতীয় কার্যক্রমে মুহতামিম সাহেবের অন্যতম সহযোগী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
সবক ইফতিতাহ
২০০৫ এর ২৫শে নভেম্বর। জামিআর ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। সেদিন জামিআর ইফতিতাহ তথা সবক উদ্বোধন হয়। জামিআর পৃষ্ঠপোষক, বড় হুজুর (দামাত বারাকাতুহুম) এর মহান পীর ও মুর্শিদ আল্লামা শাহ আব্দুল মতীন বিন হুসাইন (দামাত বারাকাতুহুম) তাশরীফ আনলেন। স্টেজে উঠে কুরসীতে সমাসীন হয়ে খুতবা পাঠ করতেই হযরত ডুকরে কেঁদে উঠলেন। মাসুম বাচ্চার ন্যায় নিরন্তর কেঁদেই চলেছেন তিনি। কান্না যেন আর থামছেই না। আঁখি যুগল থেকে বাঁধ ভাঙা প্লাবনের ন্যায় অশ্রুধারা গন্ড দেশ বেয়ে যমীন স্পর্শ করছিল। মনে হচ্ছিল, এ যেন রব্বে কারীমের পক্ষ থেকে মাকবুলিয়াতের সুস্পষ্ট স্বীকৃতি। তারপর থেকে শুরু হলো পড়ালেখা। জ্ঞান-সরোবরে অবগাহন করে সময় কাটতে লাগলো তালিবুল ইলমদের। মধু মক্ষিকার গুঞ্জনে মুখরিত হয়ে উঠলো গোটা পরিবেশ।
কষ্টের নজরানা
বড় হুজুরের ফিকির, নিরলস প্রচেষ্টা, সুনিপুণ পরিচালনা, ছাত্রদের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং গভীর রাতের দুআ-কান্নাকাটির বদৌলতে প্রথম বছরেই পড়ালেখা ও আমল-আখলাকের এমন এক নূরানী পরিবশে তৈরি হলো যে, মনে হতে লাগল যেন আকাবিরের সোনালী অতীত ফিরে এসেছে। প্রত্যেক ছাত্রের মাঝে যেন আকাবিরের রং প্রস্ফুটিত হচ্ছে। ফলে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ইলম অন্বেষণের প্রবল তৃষ্ণা নিয়ে ছুটে আসে তালিবানে ইলমের নুরানী কাফেলা। ছাত্র সংখ্যার তূলনায় জায়গা ছিল একেবারেই অপ্রতুল। তাই বাধ্য হয়ে সামনের অবশিষ্ট উম্মুক্ত জায়গায় একের পর এক বারান্দা বৃদ্ধি করা হচ্ছিল। বৃদ্ধি করতে করতে এক পর্যায়ে পূর্ণ খালি জায়গাটি বিশাল এক টিনশেড ঘরে পরিণত হলো। এ ঘরের চালাটি ছিল মাথা ছুইছুই। গ্রীষ্মকালের প্রচণ্ড গরমে ফ্যানের ব্যবস্থা ছিল ব্যর্থচেষ্টা। কারণ গরমের তীব্রতায় ফ্যানের বাতাস লুহাওয়ার রূপ নিতো। গভীর রাতে সেই বাতাস কিছুটা আরামদায়ক হলেও বিপত্তি ঘটতো বিদ্যুৎ চলে গেলে, তখন ভেতরে অবস্থান করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠতো। গরমের তীব্রতায় বাইরে এসে পায়চারি করে ছাত্র-উস্তাদের বিনিদ্র রজনী কাটানোর ঘটনা ঘটতো অহরহ। বাথরুম ও অজু-ইতিঞ্জাখানা এতটা স্বল্প পরিসরে ছিল যে, প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণে ছাত্ররা রীতিমতো বিড়ম্বনার শিকার হতো। ছাত্রদের ভিড়ে গোটা পরিবেশটা গিজগিজ করতো। টিনে ঢাকা সেই ছাপড়ার চারপাশ আবদ্ধ থাকায় পর্যাপ্ত অক্সিজেন সর্বরাহ ঘটতো না। ফলে বহু ছাত্র অসুস্থ হয়ে পড়তো। সেই দুর্দিনে ছাত্র-উস্তাদদের অবর্ণনীয় কষ্টের কথা মনে পড়লে আজও আমরা অশ্রুসিক্ত হয়ে যাই। সেই নাযুক পরিস্থিতির বিবরণ বাস্তবিক অর্থেই কলমের আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়। যারা সেই পরিস্থিতির শিকার হয়েছিলেন, তারাই বলতে পারবেন কতটা কষ্ট ও বেদনার ছিল সেই দিনগুলো। এর মধ্যেই আহলে সুফফ্ফার যোগ্য উত্তরসূরী, নববী দরবারের অতিথিবৃন্দ তালিবানে ইলম "রুহবানুললাইল ওয়া ফুরসানুননাহার" এরভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে জ্ঞান সাধনায় কঠোর অধ্যবসায়ের মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছিলো। তাদের কন্ঠে যেন উচ্চারিত হচ্ছিল,
জীর্ণ-শীর্ণ, রিক্ত-নিস্ব, তবুও আমরা ধনী,
ফকীরীর মাঝে আমীরী শান আমরাই শুধু জানি।"
কিন্তু এমন কঠিন পরিবেশেও ছাত্রদের অক্লান্ত পরিশ্রম, মেহনত-মোজাহাদা ও শিক্ষকদের সার্বিক তত্ত্বাবধান, সর্বোপরি আল্লাহ পাকের অশেষ অনুগ্রহে মাদরাসার তালিমে শতভাগ সফলতার পাশাপাশি যখন বেফাক বোর্ডেও ঈর্ষনীয় ফলাফল অর্জন হতো তখন সকলের দিল খুশিতে ভরে উঠতো। এভাবে দেখতে দেখতে সেই ভাড়া বাড়ীতে পাঁচটি বছর অতিক্রান্ত হয়ে যায়। প্রত্যেক বছরান্তে একেক জামাত করে বাড়ানো হচ্ছিল। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছাত্রসংখ্যাও কল্পনাতীত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ফলে মাদরাসার জন্য একটি নিজস্ব জায়গা ও নিজস্ব ভবন সময়ের অপরিহার্য প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু এযে বিরাট ব্যয়বহুল ব্যাপার। মাদরাসার তো কোন ফান্ড নেই, নেই নিজস্ব জমি সংগ্রহের বাহ্যিক কোন ব্যবস্থা। তবে গোটা ভূখণ্ডের মালিক আল্লাহ পাক চাইলে কোন উপায় উপকরণ ছাড়াও সবকিছুর ইন্তেজাম করতে পারেন। আল্লাহ পাকের প্রতি এ অগাধ বিশ্বাস জামিআর প্রাণপুরুষ বড় হুজুরসহ সকল তালিবুল ইলমের অন্তরে বদ্ধমূল ছিল।
কিন্তু এমন কঠিন পরিবেশেও ছাত্রদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও মেহনত-মোজাহাদা,শিক্ষকদের সার্বিক তË¡বধান, সর্বোপরি আল্লাহ পাকের অশেষ অনুগ্রহে মাদরাসা পরীক্ষায় শতভাগ সফলতার পাশাপাশি যখন বেফাকের ঈর্ষYxয় ফলাফল প্রকাশিত হতো, তখন ছাত্র-শিক্ষক সকলের দিল খুশিতে ভরে উঠতো। এভাবে দেখতে দেখতে সেই ভাড়া বাড়ীতে পাঁচটি বৎসর অতিক্রান্ত হয়ে গেলো। প্রত্যেক বছরান্তে একেক জামাত করে বাivনো হচ্ছিল, এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছাত্র সংখ¨vও কল্পানাতিত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছিল, ফলে মাদরাসার জন্য একটি নিজস্ব জায়গা ও নিজস্ব ভবন সময়ের অপরিহার্য প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু এ যে বিরাট ব্যয়বহুল ব্যvপার! মাদরাসার তো উল্লেখযোগ্য তেমন কোন ফান্ড নেই, নেই নিজস্ব জমি সংগ্রহের বাহ্যিক কোন ব্যবস্থা!!
তবে গোটা ভূখণ্ডের মালিক আল্লাহ পাক চাইলে কোন উপায় উপকরণ ছাড়াও সবকিছুর ইন্তেযাম করতে পারেন, আল্লাহ পাকের প্রতি এ অগাধ বিশ্বাস জামিআর প্রাণ পুরুষ বড় হুজুর সহ সকল তালিবুল ইলমের অন্তরে বদ্ধমূল ছিল।
নিজস্ব জমির ইন্তেজাম
ছাত্র-উস্তাদ সকলের দৈনন্দিন মামূল ছিল দোআ-কান্নাকাটি। সে সময়ের একমাত্র সম্বলই ছিল এই রোনাজারি। আর মুমিনের চোখের অশ্রু আল্লাহর কাছে অত্যন্ত প্রিয় হয়ে থাকে। তাইতো অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জামিআর জন্য আল্লাহ পাক একটা নিজস্ব জমির ব্যবস্থা করে দিলেন। ঐ সময়ে জামিআর মক্তব বিভাগের শিক্ষক কারী সাখাওয়াত সাহেবের মাধ্যমে বড় হুজুর (দামাত বারাকাতুহুম) অবগত হলেন যে, নারায়ণগঞ্জের জালকুড়ী নিবাসি হাজী আলাউদ্দিন সাহেব মাদরাসার জন্য এক খণ্ড জমি দান করতে আগ্রহী। তখন বড় হুজুর ঐ মহল্লার তৎকালীন ইমাম মাওলানা মুনীরুল ইসলাম ফারুকী সাহেবের সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেন।
অতপর হাজী আলাউদ্দিন সাহেব রায়ের বাগে এসে জামিআর সার্বিক পরিস্থিতি ও ছাত্রদের নূরানী জমায়েত দেখে মুগ্ধ হন এবং তৎক্ষণাতই জামিআর নামে জমি প্রদানের জন্য প্রস্তুত হয়ে যান। কিন্তু বড় হুজুর বললেন, আমার মুরব্বী হচ্ছেন ঢালকা নগরের হযরত ওয়ালা (দামাত বারাকাতুহুম)। যদি আপনি জামিআর নামে জমি প্রদানে আগ্রহী থাকেন, তাহলে আপনি আমার হযরতের হাতেই বুঝিয়ে দিবেন। হাজী সাহেব তৎক্ষণাৎ ঢালকা নগরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যান এবং হযরত ওয়ালার সামনে নিয়তকৃত জমিটি জামিআ রাব্বানিয়ার নামে দান করার আগ্রহ প্রকাশ করেন। হযরত ওয়ালা বললেন, ‘হাজী সাহেব, আপনি কিন্তু দান করছেন একমাত্র আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি ও পরকালের অনন্ত সফলতার জন্য। সুতরাং দুনিয়াবী কোন পদ-পদবীর ইচ্ছা থাকতে পারবে না।’ তখন হাজী সাহেব বড় হুজুরসহ কতিপয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে নিঃশর্তভাবে একমাত্র পরকালে নাজাতের আশায় জমিটি জামিআর নামে প্রদান করতে সম্মত হন এবং অকুণ্ঠচিত্তে ঘোষণা করেন, আমি পার্থিব কোন জশ-খ্যাতি বা পদ-পদবী চাইনা। আমি চাই আলেম-ওলামা ও তালিবুল ইলমদের আন্তরিক দোআ এবং পরকালের নাজাত। হযরত ওয়ালাও তাঁর আন্তরিকতায় খুশি হয়ে জমি গ্রহণের আবেদন মঞ্জুর করেন।
অতঃপর ২০০৯ সালের ৩০ শে আগস্টে জামিআর নিজস্ব জমি দলীলের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন হয়। জমি রেজিস্ট্রেশনের সময় মেজিস্ট্রেটের সামনে হাজী সাহেব আবেগাপ্লুত হয়ে বড় হুজুরের হাত চেপে ধরে বললেন, ‘হুজুর! আল্লাহ যেন আমাকে দেখিয়ে নেন!’ (আল্লাহ পাক হাজী সাহেবকে উভয় জাহানে সৌভাগ্যবান করুন। আমীন। )
এবার জমি ভরাট ও ঘর নির্মাণ করে নিজস্ব জায়গায় বসে যাওয়ার পালা। কিন্তু এখানেও ফাণ্ডের বেহাল অবস্থা। বাহ্যিক কোন উপায়ই তখন ছিলনা। তাই সর্বপ্রথম জামিআর উস্তাদগণ নিজ নিজ সাধ্যানুযায়ী জমি ভরাটের এই বিশাল ব্যয়ে অংশগ্রহণ করলেন। অতঃপর তালিবুল ইলমরাও এই মহান কর্মযজ্ঞে স্বতঃস্ফুর্তভাবে শরীক হলো। ভরাট কার্যক্রমের সূচনা এভাবেই হয়, আল্লাহ পাকের মেহেরবানীতে প্রায় সাত শতাধিক ট্রাক বালু ফেলে জমি ভরাট করা হয়।
এর মাঝে একদিন জামিআর পরম হিতাকাঙ্ক্ষী আল মদিনা নার্সিং হোম (রায়ের বাগ) এর স্বত্বাধিকারী জনাব মীযানুর রহমান সাহেব তাঁর বন্ধু জনাব আলহাজ্ব মশিউর রহমান তোতা মিয়া সাহেবকে নিয়ে রায়ের বাগে আসেন। জামিআর সার্বিক বিষয়ে মুগ্ধ হয়ে তিনি জামিআর নিজস্ব জমিতে ঘর নির্মাণের খেদমত করার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন এবং ঘর নির্মাণের সিংহভাগ খরচ তিনি একাই বহন করেন। জামিআর সবকিছু তখনও রায়ের বাগে। সরেজমিনে থেকে নিজস্ব জায়গায় ঘর নির্মাণের যাবতীয় কাজ পরিচালনা করেছেন জালকুড়ীস্থ জনাব আলহাজ্ব আব্দুল মুমিন সাহেব । আল্লাহ তাআলা সকলকে উভয় জাহানের কল্যাণ দান করেন। আমীন।
আল বিদা রায়ের বাগ!!
জালকুড়ীতে ঘর নির্মাণ মোটামুটি সম্পন্ন। এবার বিদায়ের পালা। রায়ের বাগ থেকে জামিআর আনুষ্ঠানিক বিদায়ের প্রাক্কালে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। জামিআর অস্তিত্ব মিশে আছে যেই মাটির সাথে, বহু চড়াই উৎরাইয়ের নিরব সাক্ষী যেই ভূমি, উস্তাদ-ছাত্র সকলে অশ্রুসিক্ত নয়নে অশ্রুভেজা দৃষ্টিতে সেই জীর্ণ পরিবেশের দিকে শেষ নজর বুলিয়ে জালকুড়ীর পথে পা বাড়ান। ইথারে যেন ধ্বনিত হলো "আল বিদা রায়ের বাগ! আল বিদা!!
জালকুড়ি আসার পরও প্রাথমিক পর্যায়ে বড় শোচনীয় অবস্থা ছিল। ফান্ডের দূর্বলতার দরুণ ঘরের দরজা, জানালাসহ স্বাভাবিকভাবে বসবাস উপযোগী অনেক কিছুরই অভাব ছিল। ঝড়-বাদল ও বিভিন্ন প্রাকৃতিক দূর্যোগের সাথে আলিঙ্গন করে কেটেছে বহু বিনিদ্র রজনী। জনমানবশূন্য এলাকা ছিল মরুভূমির ন্যায়। বিদ্যুতের সংযোগ ছিল ভীষণ দুর্বল। বাতিগুলো মিটমিট করে জললেও ফেন ঘুরতো না বললেই চলে। বছরে কয়েক মাস টানা জলাবদ্ধতার ফলে যাতায়াত ব্যবস্থা ছিল চরম দূর্ভোগের। নৌকাই ছিল মেইন রোড পর্যন্ত যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম।
এমনকি ২০১৭ সালে লাগাতার ভারি বৃষ্টি বর্ষনের ফলে জামিআর চারপাশ প্লাবিত হয়ে যায় এবং মাদরাসা ও মসজিদের ফ্লোর হাটু পানিতে তলিয়ে যায়। তখন পড়া-লেখার ধারা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে ছাত্র-উস্তাদ সকলে ফতুল্লা-নয়ামাটি তাবলীগী মার্কাযে পাড়ি জমিয়ে দীর্ঘ 3 মাস পর্যন্ত অবস্থান করেন।
কুদরতের কী খেলা! এ কোমর পানির মধ্যেই জামিআর বহুতল ভবনের নির্মানাধীন প্রথম তলার ছাদ ঢালাইয়ের কাজ সম্পন্ন হয়। কিন্তু জলাবদ্ধতার এই কঠিন পরিস্থিতে কাজটি মোটেও সহজ ছিলনা। এখানেও চরম কষ্ট-মুজাহাদার নজরানা পেশ করতে হয়েছে। ছাদে রড বাঁধার কাজ সম্পন্ন। কিন্তু তলিয়ে যাওয়া রাস্তা দিয়ে বালু, সিমেন্টের গাড়ি আসা অসম্ভব। তখন ছাত্র-শিক্ষক সকলে মিলে কোমর সমান পানিতে মাথায় করে, কাধে করে এবং নৌকায় করে মালামাল বহনের যেই বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করেছে সে দৃশ্য আজও চোখের সামনে জলজল করে।
যাইহোক আলহামদুলিল্লাহ আজ বারো বৎসর যাবৎ জামিআর যাবতীয় কার্যক্রম নিজস্ব জায়গায় অত্যন্ত সুন্দর ও সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এখানে আসার পর উস্তাদদের নিরলস প্রচেষ্টা ও দোআ কান্নাকাটির ফলে আল্লাহ পাকের নিজ করমে জামিআর পড়ালেখা, তালীম তরবিয়ত ও পরিধি সম্প্রসারণসহ সার্বিক বিষয় উন্নতি অগ্রগতির একেক সিড়ি অতিক্রম করতে থাকে।
রচনায়ঃ
মুহাম্মদ মাহমুদ হাসান রব্বানী
ফাযেল, অত্র জামিআ